নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও তাঁর আাদর্শ
নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু ও তাঁর আদর্শের প্রাসঙ্গিকতা
লেখক- বিভাস ঘোষাল
পৃথিবীর ইতিহাসে নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসু একজন বিপ্লবী শ্রেষ্ঠ হয়ে বরণীয় হয়ে রয়েছেন। ভারতের ইতিহাসে নেতাজির অবদান কোনদিন ভুলবার নয় । নেতাজির স্বপ্ন ছিল একটি স্বাধীন সমৃদ্ধশালী অবিভক্ত ভারত গঠন। যেই ভারতে বিভেদ থাকবে না, বৈষম্য থাকবেনা । নিজের জীবন তুচ্ছ করেও তিনি এই আদর্শের জন্য নিজেকে সঁপে দিয়েছিলেন। এই মহান বিপ্লবীর গ্রন্থ তরুনের স্বপ্ন, Indian Struggle, Indian Pilgrim ইত্যাদি বইতে তাঁর আদর্শের আভাস পাওয়া যায়। আজাদ হিন্দ বাহিনীতে হিন্দু মুসলিম শিখ ইত্যাদি সমস্ত জাতির প্রতিনিধিত্ব লক্ষ করা যায়। এজন্য তাকে একথা বলতে হয় নি যে আমি মুসলিম বা শিখদের ভালোবাসি। তার ডাকে বহু ভারতীয় দেশের স্বাধীনতার জন্য নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছিল।
কি ছিল তার মধ্যে যে মানুষ এক ডাকে নিজেদের জীবন পণ করে ঝাঁপিয়ে পড়ত স্বাধীনতার জন্য। আপোষহীন সংগ্রামী সুভাষ চন্দ্র বসু কখনও নিজের আদর্শের সঙ্গে আপোষ করেননি। স্বাধীনতা ছিল তার জীবনের মূল মন্ত্র। যে করেই হোক স্বাধীনতা পেতে হবে। এ জন্য তিনি ভয়ংকর সব বিপদের সম্মুখীন হয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে টলানো যায়নি। আদর্শবান এই স্বাধীনতা সংগ্রামী কোনদিন অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ করেননি। এজন্য তাঁকে কম মূল্য দিতে হয়নি। এমনকি শেষ পর্যন্ত তাঁকে দেশও ত্যাগ করতে হয়েছিল। তবে দুর্ভাগ্য এই যে দেশের মহান বিপ্লবীকে তাঁব প্রাপ্য সম্মানটুকু আমরা দিতে পারিনি। 1942 স্বাধীনতা আনেনি, স্বাধীনতা এনেছিল ১৯৪৫ এর Indian National Army ও সুভাষচন্দ্র বসুর ঝড়। যার প্রেরণায় British India- র নৌবাহিনীও বিদ্রোহী হয়ে পড়েছিল। কিন্তু ইতিহাসে বিকৃত পক্ষপাতপূর্ণ রচনার মধ্যমে নেতাজীর অবদানকে, নৌবাহিনীর অবদানকে অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়েছে। ভারত অহিংসার মাধ্যমে স্বাধীন হয়নি। হলে ৩০০০০ উপর সৈনিক এবং অসংখ্য বিপ্লবীর আত্মত্যাগ এর ব্যাখ্যা আমরা কিভাবে দেবো? তাহলে মেনে নিতে হয় ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদ,বিনয়-বাদল- দিনেশ, যতীন দাস, বাঘা যতীন এর মত মহান বিপ্লবীগণের আত্মত্যাগ মিথ্যা। বিকৃত ইতিহাস একটা জাতিকে বিকৃত করে। তা-ই আমাদের ক্ষেত্রে হয়েছে । যারা শুধু গদি আর পদ চেয়েছে তাদের ইতিহাসকে মহান করে দেখানো হয়েছে।
নেতাজী হিপোক্রিট ছিলেন না। গান্ধিজির নেতৃত্বে কংগ্রস, কিভাবে ও কোন অহিংস যুক্তিতে ব্রিটিশদের প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সাহায্য করেছিল? একজন অহিংস ব্যক্তি সকল পরিস্হিতিতেই, সমস্ত অবস্হাতেই অহিংসার পথে অবিচল থেকে সমরুপতা বজায় রাখবেন। শুধুমাত্র বেছে বেছে ভারতীয়দের ক্ষেত্রে বেছে নেবেন না। মাস্টারদা সূর্যসেনকে যে অমানুষিক নির্যাতনের পর হত্যা করা হয়েছিল তার কোন প্রতিবাদ হয়নি। ভগৎ সিংহের মৃত্যু কি অহিংস ছিল? গান্ধী কেন ব্রিটিশদের অহিংস পথে চলতে বললেন না? তিনি কেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ -এ সৈন্য সংগ্রহ করলেন বৃটিশদের হয়ে লড়াই করার জন্য? কেনো তিনি কাইজার-ই- হিন্দ পদক পান? ১৮৯৯-১৯০২ বুয়র যুদ্ধ,১৯০৬ সালে জুলুর যুদ্ধ, প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের যুদ্ধে সাহায্যের জন্যই ১৯১৫ সালে তিনি যে কাইজার- হিন্দ পদক পান। তিনি অহিংস কি করে হন বা সত্যাগ্রহীই বা কি করে হন? আবার ১৯১৯ সালের এপ্রিলে জালিওয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকান্ড ঘটল আর গান্ধিজির পদক ফেরতের সময় ১৯২০ সাল- প্রতিবাদে পদক ফেরাতে এত সময় লাগল? ঐতিহাসিকদের নাকি নিরপেক্ষ হতে হয়? এই নৃশংস ঘটনার পর যখন আন্দোলন তীব্র করার প্রয়োজন ছিল তখন তিনি রাওলাট সত্যাগ্রহ বাতিল করলেন, তিনি কি প্রতিপদে ব্রিটিশদের সাহায্য করেননি? তাহলে প্রতিপদে সুভাষচন্দ্র বসুর পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব গান্ধিজী ও তাঁর অনুগামীদের ভোটে পরাস্ত হত কেন ? কংগ্রেস কি আদৌ স্বাধীনতায় আগ্রহী ছিল? নাহলে সুভাষচন্দ্র বসুর উপর এত রাগ কিসের? ব্রিটিশ প্রভুদের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হওয়ার ভয় কি ছিল? ১৯১৪ সাল নাগাদ গান্ধিজি ব্রিটিশ সেনা বাহিনীতে Seargeant Corpes হিসেবে তাহলে কি করছিলেন? মনে রাখতে হবে ওই সময় বিপ্লবী আন্দোলন তীব্রতর হচ্ছিল, রাসবিহারী বসু ও গদর দলের বিদ্রোহের পরিকল্পনা ব্যর্থ হলেও তার রেশ কিন্তু ছিল। এই সময় গান্ধির ভারত আগমন ব্রিটিশদের পক্ষে কি শুভ হয়নি? সবই কি অহিংস ও সত্যাগ্রহের ছদ্মবেশে উড়িয়ে দেওয়া যায়?
আরো প্রশ্ন আছে, একজন নিরপেক্ষ মানুষ একটু লক্ষ করলেই এই অসংগতি গুলি ধরতে পারবেন। কেনইবা ব্রিটিশ দের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম আরো তীব্র করার সুভাষ বসুর প্রস্তাব নেহেরু-গান্ধি সহ কংগ্রেসের গাত্রদাহের কারন হল? গান্ধীজি নাকি অহিংস গনতন্ত্রি। তাহলে ত্রিপুরি কংগ্রেসে সুভাষচন্দ্র বসুর জয় লাভের পর গান্ধি ও কংগ্রেসের দক্ষিনপন্থি দের আচরণ কোন তন্ত্রি? তাঁদের কি ভয়ছিল সুভাষচন্দ্র বসু এবার স্বাধীনতার জন্য ঝাঁপাবেন, আর সেটা কি তাদের পছন্দ ছিলনা? একজন নব নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট এর সাথে এই আচরণ কি ফ্যাসীবাদের থেকে কিছু কম ছিল?এই প্রশ্নগুলো ঐতিহাসিকরা কেনো করলেননা?কেনো তাদের মাথায় এলনা ১৯৪২ এর ভারতছাড়ো আন্দোলনের পর কংগ্রেস কি আন্দোলন করেছিল স্বাধীনতার জন্য, যে তাদের স্বাধীনতার জন্য কৃতিত্ব দিতে হবে! তাহলে ১৯৪৫-৪৬ এর সংগ্রামের একবছরের মধ্যে যেখানে স্বাধীনতা এল, সেখানে ৫ বছর আগের আন্দোলনের কৃতিত্ব কতটা? প্রশ্নগুলো কি অযৌক্তিক?নাকি গোপন সমঝোতা বা রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা তাদের অনৈতিক পক্ষপাতপূর্ণ করে তুলেছিল? এই কি অহিংসার নমুনা!
সুভাষ বসু প্রথম থেকেই বিপ্লবীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছিলেন। তার লক্ষ্য ছিল স্থির। যখন তিনি নির্বাসনে ইউরোপে ছিলেন নিজের পরিকল্পনা ছকে ফেলেছিলেন।তাঁর একটাই স্বপ্ন ছিল স্বাধীনতা। ব্রিটিশদের ভারত থেকে তাড়ানো। দয়া ভিক্ষার মাধ্যমে নয়, নিজেদের আত্মশক্তির মাধ্যমে তিনি দেশকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন। দেশ স্বাধীন হয়েছিল সঠিক, কিন্তু যিনি ভারতকে স্বাধীন করলেন, তিনিই কিনা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর থেকে সরকারি ভাবে পেলেন যুদ্ধপরাধীর সম্মান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এটলিকে লেখা নেহেরুর চিঠি তা প্রমান করে। কেনো নেহরু নেতাজীকে ভারতে ঢুকতে দেবেননা বলেছিলেন? কাদের খুশি করতে তিনি ভারতের মহান সন্তানকে অপমান করেছিলেন? কেনো স্বাধীনতার পরও বৃটিশ গোয়েন্দা দপ্তরকে ভারত সরকার সুভাষ বসুর পরিবারের উপর নজরদারির রিপোর্ট পাঠাত? বাংলার তথা পৃথিবীর মহান বিপ্লবীর সাথে এই নজিরবিহীন বিশ্বাসঘাতকতা তৎকালীন ভারত ও বাংলা সরকারের পক্ষে সমান লজ্জাজনক। সুভাষ বসুর ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। গান্ধিও কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীরা এই সময় ব্রিটিশদের সাহায্য করতেই বেশি মনোযোগী ছিলেন। তাদের কাছে ভারতের স্বাধীনতা থেকে বেশি ছিল লন্ডনের উপর অনুকম্পা । জার্মানি সাম্রাজ্যবাদী ছিল কিন্তু সাম্রাজ্যবাদের জন্মদাতা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নয়! মাষ্টারদাকে নৃশংসভাবে হাতুড়ি দিয়ে দাঁত ভেঙে, নখ উপড়ে, সমস্ত জয়েন্ট ও হাড়গুলোকে গুড়ো করে তারপর ফাঁসি দিয়ে হত্যা এবং বঙ্গোপসাগরে কফিনবন্দী দেহ ভাসিয়ে দেওয়া। ভগৎ সিং, সুখদেব, রাজগুরু কে ফাঁসির পর একই ভাবে দেহ প্রথমে কুচিকুচি করে কেটে, তারপর আগুনে পুড়িয়ে সরযু নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া, চা বাগানের শ্রমিকদের উপর ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে হত্যা- অহিংসের নামান্তর ছিল কি?
প্রশ্নগুলো বড্ড খোঁচা দেয়।
সুভাষচন্দ্র বসুর আদর্শ ও বর্তমান প্রেক্ষাপট:
সুভাষ চন্দ্র বসু বলতেন এক সৈনিক হিসেবে সর্বদা তিনটি আদর্শ দ্বারা চালিত হবে ।এই আদর্শগুলি হল- সত্য, কর্তব্য ও আত্মবলিদান। যে সিপাহী দেশের প্রতি বিশ্বস্ত থাকে এবং দেশের জন্য কর্তব্য ও বলিদান দিতে সর্বদা প্রস্তুত থাকে, সে অজেয়। তুমিও যদি অজেয় হতে চাও তাহলে এই তিনটি আদর্শ মেনে চল। সিঙ্গাপুরে দেওয়া একটি বক্তৃতায় তিনি বলেছিলেন, সব থেকে বড় অপরাধ অন্যায়কে সহ্য করা এবং অন্যায়কারীর সঙ্গে সমঝোতা করা।
বর্তমানে এখন যে রোগ ধরা পড়েছে তা হল দুর্নীতির সঙ্গে সমঝোতা, অন্যায়কারীর সঙ্গে সমঝোতা যা সমাজকে অন্ত:সারশূন্য করে দিচ্ছে। চোখের সামনে নারী নির্যাতন হচ্ছে, ঘুষ নিতে দেখা যাচ্ছে, কিন্তু আমরা পরিবারের দোহাই দিয়ে জীবনের ঝুঁকির দোহাই দিয়ে চকরির দোহাই দিয়ে সবকিছুর সাথে সমঝোতা করি। নেতাজি বলতেন সমঝোতার চিন্তা বড্ড অপবিত্র বস্তু। তিনি বলতেন আমাকে তৈরি করেছে সংঘর্ষ, এই সংঘর্ষই আমার মধ্যে আত্মবিশ্বাস উৎপন্ন করেছে যা আগে ছিলনা। কষ্টের আন্তরিক নৈতিক মূল্য আছে। আমার জন্মগত প্রতিভা ছিল না, কিন্তু কঠোর পরিশ্রম থেকে বাঁচার প্রবৃত্তি আমার ছিলনা। আমরা সংঘাত ও তা সমাধানের মাধ্যমেই এগিয়ে চলি। আমাদের অবস্থা যতই ভয়ানক হোক বা কন্টকময় হোকনা কেনো তবুও আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। সাফল্যের দিন দূর হতে পারে, তবে তা অনিবার্য। যদি সংঘর্ষই না থাকে, ভয়ের সম্মুখীনই হতে না হয়, তখন জীবনের অর্ধেক স্বাদই শেষ হয়ে যায়।
তাই বর্তমান সময়ে এই কথাগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া খুব প্রয়োজন। দেশের স্বাধীনতা এসেছে ঠিকই। কিন্তু এখনো আমরা নিজেরা নিজেদের পরাধীন করে রেখেছি ভয় এর কাছে। দুর্ধর্ষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে সেই যুগে নেতাজী আত্মশক্তি বলে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বলেছিলেন আমাদের কর্তব্য হল- স্বাধীনতার মূল্য রক্ত দিয়ে চোকাতে হবে। আমাদের আত্মবলিদান ও পরিশ্রমের দ্বারা যে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে তাকে রক্ষা করার শক্তি থাকতে হবে। এখন বার বার মনে হয় সেই শক্তি কি আমাদের আছে? আমরা তো এখনও পরাধীন? কিসের এত ভয়? সত্যি কথা বলতে ভয় কিসের? তিনি বলেছিলেন আলাপ আলোচনা করে কখনোই স্হায়ী পরিবর্তন হয়নি। আজ আমাদের ভিতরে কেবল একটাই ইচ্ছা থাকতে হবে - মৃত্যুর ইচ্ছা, যাতে স্বাধীনতার পথ শহীদের রক্তে প্রশস্ত হয়, যাতে ভারতবর্ষ বেঁচে থাকে।
বর্তমানে নেতাজির আদর্শ গুলি বড্ড বেশি প্রাসঙ্গিক মনে হয়। কাউকে পড়ে থাকতে দেখে অসুস্থ দেখেও আমরা সাহায্যের হাত বাড়াই না। চোখের সামনে নারী নিগ্রহ দেখলেও এগিয়ে যাই না। কোনদিন দেখা যাবে নিজের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটছে, তখন কেউ এগিয়ে আসবেনা। কাউক ঘুষ নিতে দেখলে আমরা তাকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা করি। আমরা হয়তো সুযোগ পাইনা তাই নিই না। সততা বড় আপেক্ষিক। তাই নিজের ভালো, পরিবার ও পরিবেশের এবং সমাজের ভালোর জন্যই আমাদের এমন পথ বেছে নিতে হবে যে পথ আমাদের ভবিষ্যৎ কে সুরক্ষিত করবে। এই পথ নেতাজির পথ। এতে পরিশ্রম আছে দুঃখ আছে, তবে মনে আছে তৃপ্তি।
সত্যিই অসাধারণ তথ্য
ReplyDeleteExcellent
ReplyDeleteআমি কি এটা পাঠ করতে পারি
ReplyDeleteThink Pandit
ReplyDelete